রোহিঙ্গাদের পাশে কেউ কেন নেই?

রোহিঙ্গাদের পাশে কেউ কেন নেই?

এ্যামি টেনেরি,
শেয়ার করুন

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মিয়ারমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলছে। এর ফলে সেখানে দেখা দিয়েছে মানবিক সঙ্কট। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশসহ আশপাশের অঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। অবর্ণনীয় দুর্দশা মাথায় নিয়ে নৌকা ভর্তি হয়ে পালাচ্ছে তারা। আশ্রয়ের সন্ধানে তারা যেখানে ছুটছে সেখানেও ঠাঁই পাচ্ছে না তারা।

কারা এই রোহিঙ্গা?
বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারের আরাকানে (রাখাইন রাজ্য) সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠির সদস্যদের রোহিঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়। বিরোধীরা এদেরকে আলাদা কোনো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি বলতে নারাজ। তারা বলতে চায় যে রোহিঙ্গারা আসলে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী গোষ্ঠি। অন্যদিকে, রোহিঙ্গারা বলছে তারা রাখাইন রাজ্যের আদি বাসিন্দা এবং ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপনের অনেক আগ থেকেই তারা সেখানে আছে। থিঙ্কট্যাংক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে ১৭৯৯ সালের দলিলপত্রে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
রোহিঙ্গারা কেন পালাচ্ছে?
ক্রমাগত সহিংসতার শিকার এই জনগোষ্ঠি। মিয়ানমারে তাদের কোনো মৌলিক মানবাধিকার নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান-সবরকম সুযোগ থেকে এরা বঞ্চিত। তারা ‘বর্ণবাদি’ পরিবেশে বাস করছে। মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৯১ সালের মে থেকে ১৯৯২ সালের মার্চ পর্যন্ত ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গেছে। [মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচ জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত চলা সেনাবাহিনীর অভিযানে কয়েকশ’ মানুষ নিহত এবং এক হাজারের বেশি বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। তাছাড়া বাস্তচ্যুত হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি। রোহিঙ্গাদের এবং শত শত ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।] সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, দখল, জোরপূর্বক শ্রম, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং নির্বিচারের হত্যা।
২৫ বছর ধরে এ অবস্থা চলছে
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন আজকের নয়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ২০১০ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এসময় দেশটির সরকার ‘৯৬৯ আন্দোলন’ নামে বৌদ্ধভিক্ষুদের একটি সংগঠনকে কৌশলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। এই ভিক্ষুরা মুসলমান হত্যার পক্ষে নানা নৈতিক যুক্তি তুলে ধরে রাখাইনে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। ২০১২ সালে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটলে বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে পালিয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদের প্রতি কেন এই শত্রুতা?
বর্তমান বিশ্বের অনেক সমস্যার মতো রোহিঙ্গা ইস্যুর মূল খুঁজে পাওয়া যাবে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে। ১৮২৬ সালে বৃটেন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যসহ বর্তমান মিয়ানমারের বেশিরভাগ অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে। একই দেশের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল হিসেবে বাংলা অঞ্চল থেকে অনেক মুসলমান রাখাইনে গিয়ে বসতিস্থাপন করে। এ ব্যাপারে ‘দি ইকনমিস্ট’-এর ব্যাখ্যা হলো:
‘কোন ধরনের আইনগত বা অন্যকোন সুরক্ষা না থাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি দশকের পর দশক মুসলিম-বিরোধী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি রাখাইন ও কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্টদের হাতে ব্যাপক বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হয়েছে।’
মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট-এর মতে, মিয়ানমারে ১৯৮২ সালের নাগরিক আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে আইনি বৈধতা দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলো কেন তাদের নিচ্ছে না?
জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা আশপাশের দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় চাইলেও সে আশ্রয় দিতে কোন দেশ ইচ্ছুক নয় অথবা তাদেরকে স্থায়ীভাবে থাকতে দেয়ার মতো অবস্থায় নেই।
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ, এদেরকে নেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে দেশগুলো জানিয়ে দিয়েছে। থাই নৌবাহিনীও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুভর্তি নৌকা ফিরিয়ে দিচ্ছে। সংখাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে বহু বছর ধরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে। এমনিতেই এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। তার ওপর দেশটির অর্থনীতিও তেমন শক্তিশালী নয়।
মিয়ানমার সরকার কেন নির্বিকার?
এই প্রশ্নটি দালাই লামা, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও সাবেক পররাষ্টমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো। আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সহিংসতাকে বলেছেন ‘ধীরগতিতে গণহত্যা।’ বিলিয়নিয়ার জর্জ সোরস একে তুলনা করেছেন নাৎসিবাদের সঙ্গে।
খুবই সাধারণ একটি বিষয়, কেউ যদি দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে কথা বলে তা হবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট থিন শেইন রোহিঙ্গাবিরোধী ৯৬৯ আন্দোলনকে বলেছিলেন ‘শান্তির প্রতীক।’ এমনকি অং সাং সু চি, যিনি মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও সংস্কারের জন্য কয়েক দশক সংগ্রাম করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনিও লক্ষ্যনীয়ভাবে নীরব এই ইস্যুতে।

এ্যামি টেনেরি

শেয়ার করুন