কী হবে ভুটানি উদ্বাস্তুদের পুন:বসতির পর?

কী হবে ভুটানি উদ্বাস্তুদের পুন:বসতির পর?

এসএএম রিপোর্ট,
শেয়ার করুন

দুই দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ নেপাল উদারভাবে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার ভুটানি উদ্বাস্তুকে রক্ষা করে চলেছে। এসব উদ্বাস্তু মূলত হটসম্পা (দক্ষিণি) নামে পরিচিত নেপালি ভাষাভাষি ভুটানি। ক্ষমতাসীন গ্যালোপ জাতিগোষ্ঠির সূচিত ‘এক জাতি, এক সম্প্রদায়’ বিশিষ্ট ভুটান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফলে তারা বাস্তুচ্যুত হয়। দক্ষিণ ভুটান থেকে এসব লোকের নির্বাসন শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এর আগে নেপালি ভাষাভাষি সংখ্যালঘুদের ভুটান থেকে নির্মূল করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালের আদমশুমারিতে তাদেরকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভুটানের শাসকরা তাদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিক হুমকি বিবেচনা করে। পলায়নপর উদ্বাস্তুদের মৌলিক অধিকারের বিনিময়ে ভুটানে নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার পথ বেছে নেয় ভারত। অতি সম্প্রতি পুন:গণতন্ত্রায়িত নেপাল আন্তর্জাতিক মানবিক ও উন্নয়ন অংশীদারদের রাজনৈতিক, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে তাদেরকে স্বাগত জানায়।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। ২০০১ সালে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রথম দিন থেকেই ভুটান তাদেরকে ভুটানি নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার দিতে অস্বীকার করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতার অভাবে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার আদায় করে দিতে পারেনি নেপাল। কৌশলগত অদূরদর্শিতার কারণে সবচেয়ে বাস্তব টেকসই সমাধান লাভ করতে নেপাল তার বিশেষজ্ঞ অংশীদার জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার কাছ অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততা পায়নি। ইউএনএইচসিআর-এর ব্যাপারে ভুটান চরম সন্দেহ প্রকাশ করে। স্বাভাবিকভাবেই এটা উদ্বাস্তুদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পুন:বসতি কর্মসূচি
১৭ বছর ধরে নেপাল ও ভুটানের পারস্পরিক বিপরীত অবস্থান গ্রহণের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বাস্তুদের তৃতীয় কোনো দেশে পুন:বসতি স্থাপন করার আরেকটি সমাধান পেশ করে। এই প্রক্রিয়াটি ২০০৭ সালে শুরু হয়। এক লাখ ছয় হাজার ভুটানি উদ্বাস্তুকে যুক্তরাষ্ট্র (৮৫ ভাগ) এবং অন্য সাতটি দেশে পুন:বসতি স্থাপনের কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালের নবেম্বরে। তারপরও প্রায় ১২ হাজার ভুটানি উদ্বাস্তু নেপালে থেকে যায়, তাদেরকে নির্ধারিত সময়ে তৃতীয় দেশে নতুন করে বসতি স্থাপন করা যায়নি। প্রবীণ উদ্বাস্তুরা বোধগম্য কারণেই সাংস্কৃতিকভাবে অপরিচিত দেশ ও সমাজে নতুন জীবন শুরু করতে আগ্রহী ছিল না। অনেকে আবার মিশ্র বিয়ে করেছিল, বিশেষ করে নেপালিদের। ফলে তারাও যেতে রাজি হচ্ছিল না। আরো অনেকের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে অন্য দেশে পাড়ি দেয়ার মতো যোগ্যতা ছিল না। অল্প কিছু লোক অন্য দেশে বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করে। তাদের মতে, এটা আসলে জাতি নির্মূলের ভুটানি কর্মসূচিরই বাস্তবায়ন। এর ফলে ভুটানি নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ প্রায় শেষ হয়ে যাবে।
বিশ্বাসযোগ্য সমাধান
২০১৬ সাল শেষ হয়ে আসতে থাকার প্রেক্ষাপটে পুন:বসতি স্থাপন বিকল্পটির সময় বলতে গেলে আর নেই। দেশে ফেরা অসম্ভব না হলেও দৃশ্যত আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণে একমাত্র বাস্তবভিত্তিক সমাধান হলো এসব উদ্বাস্তুকে নেপালে আত্মস্ত করে নেয়া। এটা সম্ভব হবে যখন ভুটানের সাথে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার লড়াই এবং আত্মস্ত করে নেয়া উদ্বাস্তুরা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে হবে বলে অযথা ভীতি নেপাল বাদ দেবে। সমাধানের অভাবে এসব ভুটানি উদ্বাস্তু নেপালে রাষ্ট্রহীনই থেকে যাবে।
২০১৬ সালের জুনে তৃতীয় দেশে পুন:বসতি স্থাপন এবং প্রত্যাবর্তন বাস্তবায়ন ছাড়াও স্থানীয় আত্তীকরণে নেপালি ইঙ্গিত ¯্রফে রাজনৈতিক চালবাজিই ছিল। কারণ ভুটানি প্রত্যাখ্যানের ফলে প্রত্যাবর্তন প্রায় অসম্ভব বিকল্প। কেবল উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যাপকভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিই টেকসই কোনো সমাধান দিতে পারে।
দুই দশক ধরে ভুটানি উদ্বাস্তুরা নেপালে কার্যত আত্তীকরণ হয়ে আছে। তারা একই ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি অনুসরণ করে। তাদের স্থানীয় আত্তীকরণের জন্য ভূমি তৈরি হয়ে আছে। নেপাল একটি স্থায়ী সমাধান প্রস্তাব করে বিশ্বের অন্যতম একটি বিরোধপূর্ণ উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে। ভুটানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা এবং ২৬ বছর ধরে একই অবস্থায় থাকা পরিস্থিতি উদ্বাস্তুদের জীবনে এবং উদার মানবিক গুণসম্পন্ন জাতি হিসেবে নেপালের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়ছে। সমাধান পাওয়ার উদ্বাস্তুদের অধিকার রাজনৈতিক অচলাবস্থার কাছে পণবন্দি থাকতে পারে না।
নেপালের ঐতিহ্যবাহী দাতারা বিশ্বের অন্যান্য মানবিক সঙ্কটে তহবিল প্রদান নিয়ে নজিরবিহীন চাপে থাকায় নেপাল তা পাবেই কিংবা চিরদিন ধরে উদ্বাস্তু কর্মসূচি চলতে থাকবে, এমন আশা করতে পারে না। দাতাদের স্বত:স্ফূর্ততা কমে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
নেপাল এবং অবশিষ্ট ভুটানি উদ্বাস্তুদের এই সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন, নেপালে আত্তীভূত হওয়াটাই একমাত্র বাস্তবভিত্তিক সমাধান। নেপাল বিশ্বাসযোগ্য সদিচ্ছা প্রদর্শন করলে এর অংশীদাররা তা পূরণে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। বহু বছরব্যাপী এবং বহু খাতবিশিষ্ট উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের সহায়তা দেয়া হলে তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে, তারা স্বাগতিক দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে এবং এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে। ২০১৩ সালে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের ভালো একটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নেপাল একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে।
আইনগত ও সামাজিকভাবে উদ্বাস্তুদের আত্তীভূতকরণ স্বাগতিক সমাজের একটি সম্পদ। নেপালে উদ্বাস্তুদের আত্তীকরণে দাতাদের সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতি, ব্যাপকভিত্তিক কৌশল এবং বিশ্বাসযোগ্য কর্মপন্থা। নেপাল কাজটি শুরু করতে পারে উদ্বাস্তুদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নির্বাহ করার অধিকার খর্বকারী বিভিন্ন বিধিনিষেধ নমনীয় করার মাধ্যমে।
নেপালের অংশীদাররা এক লাখ ছয় হাজারের বেশি উদ্বাস্তুকে পুন:বসতি স্থাপন করার মাধ্যমেও সংহতি প্রদর্শন করেছে। দুই কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার উদার দেশটির বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নেপালে ১২ হাজার ভুটানি উদ্বাস্তেুর আত্তীকরণ নিশ্চিত করতে পারে। এটা উদ্বাস্তু ও নেপাল উভয়ের জন্যই কল্যাণকর হবে।

লেখক : জাতিসংঘ সংস্থায় কর্মরত

শেয়ার করুন