সরকার-সংসদ দ্বন্ধে সঙ্কট বাড়ছে নিরাপত্তা ভঙ্গুর আফগানিস্তানে

সরকার-সংসদ দ্বন্ধে সঙ্কট বাড়ছে নিরাপত্তা ভঙ্গুর আফগানিস্তানে

এসএএম রিপোর্ট,
শেয়ার করুন

আফগানিস্তানে তালেবানদের হামলা জোরদার হবার পাশাপাশি সরকার ও সংসদের মধ্যে দ্বন্ধ চরম আকার ধারণ করায় বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সংসদ মন্ত্রীদের ডেকে ডেকে জবাবদিহি করছে তাদের কর্মদক্ষতা ও সাফল্য নিয়ে। তিন দিনের মধ্যে অনাস্থা দিয়ে ৬ জন মন্ত্রীকে অভিসংশন করেছে সংসদ। আরো মন্ত্রীদের নাম তালিকায় রয়েছে। সংসদ এভাবে মন্ত্রীদের অভিসংশন করতে পারে কিনা এ নিয়েও বিতর্ক তোলা হয়েছে। আবার অনাস্থার মাধ্যমে বরখাস্ত করা মন্ত্রীরা প্রধান নির্বাহির নির্দেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে দেশটিতে এক নতুন ধরনের কর্তৃত্বের দ্বন্ধ দেখা দিয়েছে। এটি আগে থেকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও প্রধান নির্বাহি ড. আবদুল্লাহ আব্দুল্লাহর মধ্যকার দূরত্ব জনিত অভ্যন্তরীণ সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি নতুন তালেবান নেতা মোল্লা হাইপাতুল্লাহসহ শীর্ষ তালেবান নেতাদের সন্ত্রাসির তালিকাভুক্ত করার জন্য জাতিসংঘর প্রতি আহ্বান জানানোর কারণে নতুন করে শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে যে আলাপ আলোচনা পাকিস্তানে শুরু হচ্ছিল তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তালেবানরা এই আলোচনার জন্য যে তিনটি শর্ত দিয়েছিল তার একটি হলো তালেবান নেতাদের সন্ত্রাসির তালিকা থেকে বাদ দেয়া। প্রেসিডেন্ট গনির নতুন বক্তব্যে এই শান্তি আলোচনা কতটা এগুতে পারবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আফগান সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকায় নেতৃত্ব পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ এই বিরোধ।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা সংকট ছাড়াও কাবুলে এখন সরকার এবং সংসদের মধ্যে নতুন ধরনের এক সংঘাত দেখা যাচ্ছে। মাত্র তিন দিনের মধ্যে এমপিরা আফগান সংসদ শিক্ষামন্ত্রী ফরিদা মমান্দসহ ছয় জন মন্ত্রী বরখাস্ত করার জন্য অনাস্থা ভোট দিয়েছে। বরখাস্ত হওয়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রী ফরিদা মোমান্দ, শিক্ষা মন্ত্রী আসাদুল্লাহ হানিফ বাল্কি, পরিবহণ ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী মোহাম্মদুল্লাহ বাতাস, গণপূর্ত মন্ত্রী মোহাম্মদ বালিগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নাসরিন ওরাখিল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালাউদ্দিন রাব্বানি। আরো ১০ মন্ত্রী নোটিশ পেয়েছেন তাদের ভাগ্যও সংসদ সদস্যদের ভোটের উপর নির্ভর করছে।
মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংসদের এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ জাতীয় সরকারের ভঙ্গুরতা ও অনৈক্যেরই লক্ষণ। ছয়জন মন্ত্রীকেই তাদের অদক্ষতা এবং বরাদ্দকৃত বাজেট তহবিল সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করতে না পারার কারনে বরখাস্ত করা হলেও বাস্তব বিষয়টি হলো এটি এমন একটি সময়ে করা হলো যখন দেশটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আফগান সংবিধান অনুসারে মন্ত্রীরা তাদের কাজ সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে তাদের বরখাস্ত করার আইনগত অধিকার সংসদের আছে। যদিও বর্তমান সংসদের স্বাভাবিক মেয়াদ পার হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী বিভাগ থেকে আবেদন সত্ত্বেও মন্ত্রীদেও বরখাস্ত করার এই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় ইতিমধ্যে ভঙ্গুর পশ্চিমা সমর্থিত সরকার আরও বেকায়দায় পড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ গত শনিবার রাতে সংসদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেন যেখানে তিনি মন্ত্রীদেও তলব প্রক্রিয়া পিছানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সংসদ গত সপ্তাহে তাদের দেয়া ঘোষণা থেকে পিছু হটেনি। এ সময় তারা বাজেট যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থ মন্ত্রীদের শনিবারে তলব করার কথা জানায়। এমনিতেই ক্ষমতায় যেতে সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট গনি ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহর মধ্যে একটি অস্বস্তিকর জোট তৈরি হয়েছে যেখানে কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত সহসভাপতি রশিদ দস্তুমও অন্তর্ভুক্ত আছেন। ক্ষমতাসীনদের এই অস্তস্তিকর জোটের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে আফগানিস্তান জুড়ে তালেবান তৎপরতা। এটি দেশের নিরাপত্তায় মারাত্বক হুমকি এবং জাতীয় ঐক্য সরকারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখিন হচ্ছে। উভয় পক্ষের নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ উঠার পর মার্কিন সমর্থনে গঠিত কাবুল সরকারের উপর প্রত্যাশা ছিল যে তারা একটি সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন ও সাংবিধানিক গ্র্যান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু দুই বছরের সময়সীমা পার হয়ে গেলেও কোন প্রতিশ্রুতিই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলে এটি এমন একটি সময়ে সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি করল যখন ক্রমবর্ধমান জাতিগত উত্তেজনার কারনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চরম আকার নিয়েছে।
আফগান প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে মন্ত্রীদের বরখাস্তের সমালোচনা করে দেশের মঙ্গলের জন্য সমন প্রক্রিয়া প্রলম্বিত করা উচিত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে সময় পেলে মন্ত্রীরা উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়ের প্রয়োজনীয় তথ্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। প্রেসিডেন্ট গনি এবং ডঃ আব্দুল্লাহ দুই জনই বলেছেন, এমপিদের সিদ্ধান্ত এই সংকটময় সময়ে সরকারের উপর এক বড় রাজনৈতিক আঘাত হবে। উভয়ে সংসদেও প্রতি এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু সংসদ সদস্যরা মনে করেন যে, মন্ত্রীদের নিজেদের দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালনের চেয়ে রাজনৈতিক আগ্রহই বেশী। মন্ত্রণালয় বরং সহকারী মন্ত্রী দ্বারাই মসৃণভাবে চালানো যাবে। তাই অরাজক ও খারাপ পারফরম্যান্সের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করাই শ্রেয়।
সরকার আইনসভায় হস্তক্ষেপ করার আইনি এখতিয়ার রাখে না। ফলে দেশের অবনতিশীল পরিস্থিতি ও ঐক্য সরকারের কর্মক্ষমতা নিয়ে অসন্তোষের কারণে খুব শীঘ্রই অন্যান্য মন্ত্রীরা একইরকম অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে পারেন। এমপিদের অধিকাংশই বেশ জোরালোভাবে মনে করেন যে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সংসদের অধিকার এবং তারা কোনভাবেই এই প্রক্রিয়াকে রাজনীতিকরণ করতে দেবেন না।
অন্য দিকে যে কারণ দেখিয়ে মন্ত্রীদের বাদ দেয়া হচ্ছে সেই উন্নয়ন বাজেট পুরোপুরি খরচ করতে না পারাটা দীর্ঘসময় ধরেই দেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। পূর্ববর্তী সরকারের অনেক মন্ত্রীও তাদের উন্নয়ন বাজেটের ৫০ শতাংশও ব্যয় করতে পারেননি। বাজেটের সদ্ব্যবহার করতে না পারার মূল কারণ হিসেবে বেশকিছু বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে গুরত্বপূর্ণ একটি কারন হলো মন্ত্রী ও তাদের দলের সীমিত ক্ষমতা। যদিও অন্য কারণগুলোও একবারে উপেক্ষা করার মত নয়।
আফগান মন্ত্রণালয় ও স্বাধীন বাজেট ইউনিট Ñ এ দুই ধরনের উন্নয়ন বাজেট আছে। যেটাকে বিবেচনামূলক এবং অ-বিবেচনামূলক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যথেষ্ট ক্ষমতা এবং পরিকল্পনা থাকা সত্বেও এই অ-বিবেচনামূলক বাজেটই মন্ত্রীদের ব্যর্থতার প্রধান একটি কারণ। আরেকটি প্রধান সমস্যা তহবিলের উপর দাতাদের অসময়ে শর্ত-আরোপন। এর মধ্যে জাতীয় ঐক্য সরকারের সময় গঠন করা ন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট কমিশন (এনপিসি) সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয়। এই এনপিসি প্রকাশ্য চুক্তিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। তবে তাদের গঠন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক সমালোচনা রয়েছে। বলা হয় যে এনপিসি’র হস্তক্ষেপে বড় বড় সরকারি চুক্তিতে যে বিলম্ব হচ্ছে তার কারনেই এই বছর উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন কম হয়েছে।
মন্ত্রীরা তাদের ইম্পিচমেন্টের সময় সরকারের আমলাতন্ত্র সম্পর্কেও অভিযোগ জানায়। যদিও ন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট কমিশনের নাম বিশেষভাবে বলার সাহস তাদের ছিল না।
আফগানিস্তানে এখন যেখানে বেকারত্ব হার রেকর্ড পরিমানে বেশী সেখানে উন্নয়ন বাজেটের অপরিণত ব্যয় নিঃসন্দেহে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি করছে। উন্নয়ন বাজেট যথাযথভাবে ব্যয় করা হলে তা অন্যান্য আর্থিক সুবিধা ছাড়াও প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি হতো। যদিও, বাজেটের কম খরচ হবার সমস্যার সমাধান একবারে সব মন্ত্রীদের বরখাস্ত করলেও হবে না।
এ ব্যাপারে সরকারের কর্মদক্ষতার বিষয়টি পরিমাণগত ও উৎকর্ষতা দুদিক থেকেই কঠোরভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। এখন তারা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত খুব সাবধানে নিতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে ধীর করে ফেলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংস্কারের কাজ সেভাবে হচ্ছে না। এর বাইরে আরেকটি সমস্যা হলো মন্ত্রীদের সীমিত ক্ষমতা এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুনগত মানের অভাব। ধারণা করা হচ্ছে এই অবস্থায় মন্ত্রী বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া সরকারকে আরো দুর্বল করবে। কারন সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে ধরনের মতের ব্যবধান রয়েছে তাতে শীঘ্রই বাছাই কওে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ করা সম্ভব হবে না।
সরকার ও সংসদের মধ্যে এখন যে বিভাজন চলছে তা ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিভাজনের সুযোগ তালেবানদের পক্ষে নেয়া সহজ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি তালেবানরা বাগরাম বিমান ঘাটিতে যে হামলা চালিয়েছে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতো কঠোর ছিল এর আগে সেটাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভাজন তালেবানদের সুযোগকে বাড়িয়ে তুলেছে। আর সার্ক সম্মেলন ইস্যুতে প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসি ধরনের ভূমিকা রাখার মতো সরকারের ভারসাম্যহীন বিদেশ নীতিও দেশটির নিরাপত্তা সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলছে।

শেয়ার করুন