সাউদার্ন আইঃ দু-দিকের বিপদে

সাউদার্ন আইঃ দু-দিকের বিপদে

সুবীর ভৌমিক,
শেয়ার করুন

বিশাল আকার এবং প্রাচুর্যপূর্ণ সম্পদরাজির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সার্বভৌম দেশগুলোর জন্য কূটনৈতিক স্বায়ত্তশাসন একটি মূল্যবান সম্পদ। তাদের সামনে যখন মাত্র একটি বড় শক্তি থাকে এবং বিকল্প থাকে সামান্যই, তখন তারা সম্ভবত শেষ পর্যন্ত নির্ভরশীলই হয়ে পড়ে। তবে তাদের কাছে অনেক বিকল্প থাকলে তারা ঘাটতি পূরণ করার জন্য চৌকস কূটনীতি প্রয়োগ করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও এটা ভিন্ন নয়। এই অঞ্চলের ছোট ছোট দেশ ভারত বা চীন কোনোটিকেই অগ্রাহ্য করতে পারে না। তারা প্রায়ই বিষয়টি বলতে চায়। কিন্তু ভুল বোঝার ভয়ে তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারে না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অবশ্য নভেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের আগে তা প্রকাশ করার ওপরই জোর দিয়েছিলেন।
চীনা প্রেসিডেন্টের কয়েক ঘণ্টা ঢাকায় অবস্থানের পর ব্রিকস-বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে শি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়েই গোয়ায় (ভারত) রওনা হয়েছিলেন। ঢাকায় শির অবস্থানকালে বেইজিং ও ঢাকা প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও প্রকল্প সাহায্য চুক্তি স্বাক্ষর করে।
শাহরিয়ার কোনো রাখঢাক ছাড়াই এই কলামিস্টকে বলেছিলেন, ‘ভারত ও চীন উভয়কেই আমাদের প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন উভয়ের বন্ধু হওয়া। আমাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই। তার নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানকে একঘরে করার জন্য গোয়া শীর্ষ সম্মেলনকে ব্যবহার করতে উদ্যোগী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করার জন্য ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিলেন। কিন্তু শি’র সফরকালে শেখ হাসিনা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্ব পর্যায়ে উন্নীতও করেন।
বার্তা পরিষ্কার : ভারতের পাশে থাকবে বাংলাদেশ এবং ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ’ করার জন্য আফগানিস্তান এবং অন্যদের মতো পাকিস্তানের বিরোধিতা করবে। তবে চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশ।
বাংলাদেশ চীন পরিচালিত বিসিআইএম উদ্যোগ এবং এর ‘এক অঞ্চল এক সড়ক’ প্রকল্প দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে। কারণ ঢাকা মনে করছে, এসব উদ্যোগের ফলে তার বিপুল অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধিত হবে, বিশেষ করে এর ফলে যে আঞ্চলিক অবকাঠামো তৈরি হবে তা তার নিজের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হতে সহায়ক হবে।
যারা চীনা সাহায্য-উন্নয়ন তহবিলকে ‘চেক বুক কূটনীতি’ (অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ সুবিধা-সংবলিত কূটনৈতিক কার্যক্রম) হিসেবে কলঙ্কিত করতে চায়, তারা বিষয়টি ধরতে পারছে না। চীন কেবল এই অঞ্চলের বন্ধু বাড়ানোর জন্যই তার বিপুল সম্পদ ঢালছে না। বরং তার বৃহত্তর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমূলক ভিশনও রয়েছে। বিসিআইএম-ওবিওআর উদ্যোগগুলো ওই ভিশনের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রকাশ। এতে ছোট ছোট প্রতিবেশীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং তারাই এসব থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। অন্তত, তারা এমনটাই মনে করছে এবং অন্য কোনো দেশ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কিছু সামনে আনেনি।
ভারত তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট অর্থনীতি এবং ‘চেক বুক কূটনীতি’ নিয়ে চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করার কথা কল্পনাও করে না। বাংলাদেশকে ভারতের ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানকে ঢাকা স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু শি’র সফরকালে চীনের ২৮ বিলিয়ন তহবিল চুক্তির সাথে তুলনা করলে সেটাকে অতি সামান্যই মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অর্থনীতিগুলো বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ান জাতিগুলোকে খুবই সামান্য কিছু দিয়েছে। অন্তত চীনের তুলনায়। এ কারণেই যে হাসিনার সরকার ভারতীয় রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, সে-ও পর্যন্ত তার ব্যাপক উন্নয়ন আকাঙ্খার লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় তহবিলের জন্য দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে।
একই কথা প্রযোজ্য নেপাল ও শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও।
নেপালি প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ড বা শ্রীলঙ্কার সিরিসেনার প্রয়োজন ভারতীয় রাজনৈতিক সমর্থন, কিন্তু একই সময়ে দরকার চীনা উন্নয়ন তহবিল।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র নেপালি মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভারতের সাথে ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছি না। কিন্তু আমরা আশা করছি, দিল্লি বাস্তবতা স্বীকার করে নেবে।’
মিয়ানমারের গণতন্ত্রীপন্থী আইকন ও স্টেট কাউন্সিলর আঙ সান সু চিও দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন গিয়ে এবং পরে ব্রিকস-বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতে গিয়ে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে অবশ্য শেখ হাসিনা কিংবা আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির চেয়ে দিল্লির ওপর তিনি কম বাধ্যবাধকতাপূর্ণ।
ভারতীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাতকালে সু চি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতের উচিত হবে না নিজে থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালানো, যেভাবে তারা ২০১৫ সালে করেছে বলে দাবি করেছে। পাকিস্তানের মতো মিয়ানমারেও ভারতবিরোধী বিদ্রোহীদের ঘাঁটি থাকায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা হিসেবে সু চি স্বাভাবিকভাবেই তার ভূখন্ডে ভারতীয় কমান্ডোদের হামলা নিয়ে সামরিক নেতৃত্বের চেয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া নিয়েই বেশি চিন্তিত।
ভারতের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ঢাকা বা কাবুল স্বাগত জানাতে পারে, কারণ এসব দেশ কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। কিন্তু তা যৌক্তিক কারণেই সু চির মনে চিন্তার বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
এমনকি ক্ষমতায় আসার আগেও তিনি ইন্ডিয়া টুডের টিভি অ্যাঙ্কর করণ থাপরের সাথে সাক্ষাতকারে ভারতীয় কমান্ডোদের অভিযানে আপত্তি করে বলেছিলেন, ‘আমাদের পেছন থেকে কিছু ঘটুক, তা আমরা চাই না।’
দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতার সাথে কথা বলার সময় চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি উত্থাপন করা হলে যে উত্তরটি পাওয়া যাবে তা হলো, এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে অঞ্চলটির জন্য আরো ভালো হবে। বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ বা মিয়ানমারের বেশির ভাগ নেতাই শাহরিয়ার আলমের ‘আমাদের উভয়কেই প্রয়োজন’ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সুর মেলাবেন। আর তারা যেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে হয় তা হলো, মঞ্চে মোদির আবির্ভাবের সময় চীন-ভারত সম্পর্কের আরো উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন ঘটেছে তার বিপরীত। ভারত দৃঢ়ভাবে আমেরিকান কক্ষপথে ঢুকে গেছে, ওবামার ‘এশিয়া ভরকেন্দ্র’ কৌশলের এক ধরনের ‘ভরকেন্দ্রে’ পরিণত হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সাথে সামরিক মহড়া বাড়ানোর ভারতের সিদ্ধান্ত, ২০১৬ সালের শুরুতে একটি হিমালয় শহরে অনুষ্ঠিত তিব্বত-উইঘুর-ফালুগঙ গোপন সভার প্রতি ভারতের অনেকটা প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রদান, এর হিন্দুৎভা মতাদর্শের নেতাদের চীনা পণ্য বয়কটের প্রকাশ্য হুমকি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এর বিপরীতে ভারতের পরমাণু সরবরাহ গ্রুপে প্রবেশে চীনের বিরোধিতা, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে চীনের তহবিল প্রদান, রাশিয়াকে পাকিস্তানের পাশে নিয়ে আসার চীনা প্রয়াস হলো বেইজিংয়ের অনড় মনোভাবের প্রকাশ।
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো যেসব চায় না, এগুলো হলো তার স্পষ্ট চিত্র। তারা চায় ভারত ও চীন পরস্পরের বন্ধু হোক এবং একজনের সাথে বন্ধুত্বকে যেন অন্যজনের প্রতি বৈরিতা হিসেবে বিবেচনা করা না হয়।

লেখক : বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা এবং লেখক

শেয়ার করুন