অস্বাভাবিক সেনা নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রভাব

অস্বাভাবিক সেনা নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রভাব

অনিল চৈত,
শেয়ার করুন

ভারতের পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য শুরুতে অবশ্যই লে. জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার বিপুল অভিজ্ঞতা, কৃতিত্ব এবং দীর্ঘ সামরিক ঐতিহ্য দায়িত্ব গ্রহণের পর তার জন্য অনেক সুবিধা এনে দেবে।
লে. জেনারেলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে কঠিনটি হলো সৈনিকদের নানা উচ্চাকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে একক চেতনায় প্রতিষ্ঠানটিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তার মধ্যে সম্ভাবনা আছে এবং এখন এটা করার উপযুক্ত সময়।
দু’জন খুবই যোগ্য সিনিয়রকে ডিঙিয়ে দেয়া এই নিয়োগ নিয়ে অত্যন্ত ক্রুব্ধ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। কেবল দুই অফিসারের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও প্রত্যাশা প্রত্যাখ্যান করার জন্যই নয়, বরং সেই সাথে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেনাবাহিনীর অরাজনৈতিক প্রকৃতির ওপরও এই নিয়োগ প্রভাব ফেলবেই। এমন প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক, তথাকথিত কৌশলগত গোষ্ঠির কাছ থেকে নয়। এসব গোষ্ঠির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য তো নয়ই, বরং তা উদ্বেগজনকও।
এসব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উপযুক্ত বিবেচিত ব্যক্তিকে নিয়োগ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে সরকারের। তবে তা করা দরকার স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতার মাধ্যমে।
সামর্থ্য ও সিনিয়রিটি
সেনাবাহিনীর মতো ক্রমপরম্পরাযুক্ত কাঠামোতে কমান্ড কর্তৃত্ব নির্ধারিত হয় অপেক্ষাকৃত ভালো পেশাদার সামর্থ্য ও সিনিয়রিটির মিশেলে। ভিন্ন কিছু ঘটনার উদ্ভব না ঘটলে সিনিয়রিটি-কাম-মেধাই নির্বাচনের নীতি হিসেবে অনুসৃত হয়ে আসছিল। কর্তৃব্যরত সেনা কমান্ডার এবং আর্মি স্টাফের উপ-প্রধানদের মধ্য থেকে এই নির্বাচন করা হয়। গত ৩৭-৩৮ বছর ধরে এই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। পদোন্নতির ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিগত গুণাবলি, প্রদর্শিত কর্ম সম্পাদনা দক্ষতা এবং পরবর্তী পদের জন্য উপযুক্ততা। একটা পুরো ব্যাচ থেকে এক থেকে দু’জন মাত্র ওই অবস্থানে যেতে পারেন। এটা অন্য কোনো ব্যবস্থার মতো না হওয়ায় মেধাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে এসেছে। পরিচালনাগত ও কার্যক্রমগত চেতনার মধ্যে থাকা এর সবগুলোই এই নিয়োগের ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এগুলোর সমাধান প্রয়োজন।
প্রথমত, যে ব্যক্তিগত সামর্থ্য এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে এই নির্বাচন করা হয়েছে, তা কি লে. জেনারেল প্রবীণ বকশি এবং লে. জেনারেল পি এম হারিজের চেয়ে অনেক বেশি? সবচেয়ে বড় কথা হলো, লে. জেনারেল বকশি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ। তিনি নীরব অথচ ব্যাপকভাবে বিদ্যমান চীনা হুমকির পাশাপাশি অদম্য বিদ্রোহ মোকাবিলা করে আসছিলেন। তিনি কোর কমান্ডার হিসেবে কাম্বা ও জম্মু অনুপ্রবেশ সামাল দিয়েছেন। আর লে. জেনারেল হারিজ নানা আইডিয়ার জন্য বেশ সুনামের অধিকারী।
মূল্যায়নের ভিত্তি
তাহলে তুলনামূলক মূল্যায়নের ভিত্তি কী এবং আমরা কোন স্থান থেকে তা শুরু করবো? এটা যদি এতই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে, তবে আরো আগে কেন তা শুরু হয়নি? কাকতালীয়ভাবে এই ঘটনাও সামনে এসেছে, বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব পালনকালে অফিসারদের সাথে কেন আলোচনা করা হয়নি, প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিতে তাদের কোন কোন গুণাবলি প্রদর্শন করা প্রয়োজন? তাহলে যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য পিস ফরমেশনের ফরমেশন কমান্ডাররা যখন শুনবেন, সবকিছুই সমান এবং তাদের ভবিষ্যৎ উচ্চাকাক্সক্ষা কেবলমাত্র পূরণ হতে পারে বিদ্রোহ দমনমূলক কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে- তখন তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? ইস্টার্ন কমান্ডে দায়িত্বরত অফিসারদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে যখন তাদেরকে বলা হবে, তাদের নিজেদের কমান্ডার-ইন-চিফের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়?
কোনো অফিসারের ক্যারিয়ার গ্রাফ ও অভিজ্ঞতা সবসময় তার নিজের পছন্দের আলোকে হয় না। সামরিক বাহিনীর সচিবালয় শাখার মাধ্যমে চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে অফিসাররা তাদের সামনে আসা সুযোগের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তাদের কোনো পছন্দ নেই। কোনো সিনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে যদি যথাযথ অভিজ্ঞতা না থাকার যুক্তি উত্থাপিত হয়, তবে একই কাজের জন্য দায়ী অফিসারের ওপর তা কতটা বর্তায়? ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের পোস্টিং থেকে বঞ্চিত করার মূল্য কি তাকে দিতে হবে?
দ্বিতীয়টি এবং আরো মারাত্মক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, সরকারের প্রদর্শন করা এবং ডিঙানোর যুক্তি হিসেবে বলা বক্তব্যের আলোকে ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হওয়াতে। জাতির সামনে আসা হুমকিগুলো কি আগামীতেও স্থির থাকবে এবং তৃণমূল পর্যায়ে সীমিতই থাকবে? যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তা হলে কী হবে? যদি পদাধিকারীর মেয়াদেই এসবের পরিবর্তন ঘটে তবে কী হবে?
এরপর আমরা কাক্সিক্ষত ফল পেতে ভরকেন্দ্রে আক্রমণের জন্য যৌথতা, যৌথ বাহিনী এবং যৌথ দায়দায়িত্বের কথা বলছি। সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্বাচনের মানদ-ের জন্য সরকার কি দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষায়ণের সিদ্ধান্ত নেবে? এমনটা কি যৌথ বাহিনীর প্রতিভা আকৃষ্ট করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, যা এখনো প্রধান কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রয়েছে?
সরকারের প্রত্যাশা
তৃতীয় প্রশ্নটি হলো সেনাপ্রধানের কাছ থেকে সরকারের প্রত্যাশা। তার ভূমিকা কি উচ্চতর কৌশল নির্ধারণ এবং কৌশলগত পর্যায়ের তদারকির ব্যবস্থা করবে নাকি সম্ভবত কখনো কাজে লাগবে না এমন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত হবে? নির্বাচনের জন্য কি অভিজ্ঞতার কথাই সবচেয়ে বেশি বলা হয়নি?
আর সবশেষে সমাধান হিসেবে সময়োত্তীর্ণ সিনিয়রিটি-কাম-মেধার নীতিমালায় ফিরে আসছি। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এখন পর্যন্ত অরাজনৈতিক হিসেবে রাখার কারণ হলো, এই মূলনীতি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার যেকোনো প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে দেয়। এমনটা অব্যাহত থাকলে সশস্ত্র বাহিনীর উদীয়মান তারকারা তাদের পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য ভেতর ও বাইরের কলাকৌশলের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব কামনা করতে চাইবে।
আর সেক্ষেত্রে অরাজনৈতিক চরিত্রটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
এই অস্বাভাবিক নির্বাচন এবং ডিঙানোর নিট প্রভাব হলো ব্যাপকভিত্তিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধ উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তার জন্য স্বল্পমেয়াদি সংক্ষিপ্ত-পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি সংকীর্ণ কৌশলগত সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে।
লেখক : ভারতের সাবেক ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ। দি হিন্দু থেকে অনুদিত

শেয়ার করুন